religion.mywibes.com
~* ওঁ নম ভগবতে বাসুদেবায় *~
শ্রীমদ্ভগবদগীতা
অষ্টাদশ অধ্যায়ঃ মোক্ষযোগ শ্লোকঃ ৭৮
হে কৃষ্ণ, \'সন্ন্যাস\' ও \'ত্যাগ\' বলতে কী বুঝায় তা আমাকে বল।১ শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, কাম্য-কর্ম ত্যাগকে সন্ন্যাস বলে। আর সর্ব কর্মফল ত্যাগকে ত্যাগ বলে।২ কেউ কেউ বলেন- কাম্য মাত্রই দোষের, অতএব তা পরিত্যাজ্য। আবার কেউ কেউ বলেন- কাম্যকর্ম ত্যাজ্য নয়।৩ হে অর্জুন, তোমাকে ত্যাগ সম্বন্ধে বলছি। ত্যাগ তিন প্রকার।৪ যজ্ঞ, দান ও তপস্যা প্রভৃতি কর্ম কখনও পরিত্যাজ্য নয়। কারণ, এদের দ্বারা চিত্তশুদ্ধ হয়ে থাকে।৫ হে অর্জুন, ফলের আশা ছেড়ে এই সকল কর্ম করবে- এটিই আমার মত।৬ নিয়ত কর্ম কখনো পরিত্যাগ করতে নেই। অজ্ঞানতাবশতঃ ত্যাগ করলে তা তামসিক ত্যাগ হয়।৭ যে ব্যক্তি দুঃখের ভয়ে কর্ম ত্যাগ করে তার ত্যাগকে রাজসিক ত্যাগ বলে।৮ ফলের আশা ছেড়ে যে-কর্তব্য কর্ম করা হয় তাকে সাত্ত্বিক ত্যাগ বলে।৯ সাত্ত্বিক ত্যাগী ব্যক্তি দুঃখকর কাজে দুঃখবোধ করেন না, সুখকর কাজেও আনন্দ পান না।১০ মানুষ কাজ একেবারে ত্যাগ করতে পারে না, কিন্তু কর্মের ফল ত্যাগ করতে পারে। যিনি কর্মের ফল ত্যাগ করতে পারেন তিনিই ত্যাগী।১১ ভাল-মন্দ মিশ্রকর্মেরই এই রকম ফল। ফলত্যাগী সন্ন্যাসিগণ কর্মফল ভোগ করেন না।১২ বেদান্তমতে কর্মসম্পাদনের পাঁচটি কারণ। তা বলছি, শোন।১৩ অধিষ্ঠান, কর্তা, বিবিধ কারণ, কর্তার বিবিধ কার্য ও দৈব এই পাঁচটি কর্মসম্পাদনের কারণ।১৪ মানুষ ভালোমন্দ যা কিছু করে তা এই পাঁচটি কারণ হতেই হয়ে থাকে।১৫ অল্পবুদ্ধি ব্যক্তি তা বুঝতে পারে না। সে আত্মাকেই কর্তা বলে মনে করে।১৬ যে কর্ম করে কিন্তু ফলের আশা করে না, সে জগতকে বধ করলেও পাপের ভোগী হয় না।১৭ সাংখ্যমতে কারণ তিনটি- জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা।১৮ জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা এই তিনটি কারণ গুণভেদে হয়। বলছি, শোন।১৯ প্রাণীগণ ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু আত্মা এক। এই জ্ঞান সাত্ত্বিক জ্ঞান।২০ যে মনে করে ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীতে ভিন্ন ভিন্ন আত্মা বিরাজ করেন, তার জ্ঞান রাজসিক জ্ঞান।২১ এই জ্ঞান প্রকৃত তত্ত্ব না বুঝে এই সমস্ত বুদ্ধি কোন একটি বিষয়ে আসক্ত থাকে সেই যুক্তিবিরোধী অযথার্থ এবং তুচ্ছ জ্ঞানকে তামসিক জ্ঞান বলে।২২ যিনি আসক্তি ও ফলাকাঙ্ক্ষাহীন এবং যিনি কর্তব্য মনে করেই কাজ করেন তাঁর কাজই সাত্ত্বিক কাজ।২৩ যে ব্যক্তি আসক্তিবশতঃ ফলের আশায় কিংবা কষ্টের সাথে কাজ করে তার কাজ রাজসিক কাজ।২৪ যে ব্যক্তি পরিণাম, ক্ষয়, হিংসা কিংবা নিজের পৌরুষ না ভেবে কাজ করে তার কাজ তামসিক কাজ।২৫ যে ব্যক্তি ফলাফলে নির্বিকার, যার অহংকার নেই, সে সাত্ত্বিক কর্তা।২৬ যে ব্যক্তি আসক্ত, লোভী, লাভে আনন্দিত ও অলাভে দুঃখিত হয়, সে রাজসিক কর্তা।২৭ যে ব্যক্তি অভদ্র, অলস, শঠ ও দীর্ঘসূত্রী সে তামসিক কর্তা।২৮ সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ- এই তিনগুণ অনুসারে বুদ্ধি ও ধৃতি তিন প্রকার। এখন তোমাকে তা বলছি।২৯ যে বুদ্ধি দ্বারা প্রবৃত্তি-নিবৃত্তি, কর্তব্য-অকর্তব্য, ভয়-অভয়, মুক্তি ও বন্ধন নির্ণয় করা যায় তা সাত্ত্বিক বুদ্ধি।৩০ যে বুদ্ধি দ্বারা ধর্ম-অধর্ম কর্তব্য-অকর্তব্য প্রভৃতি বুঝা যায় না তা রাজসিক বুদ্ধি।৩১ তামসিক বুদ্ধির বলে মানুষ অধর্মকেই ধর্ম বলে মনে করে।৩২ এখন ধৃতির কথা বলছি। সাত্ত্বিক ধৃতির বলে মানুষ মন, প্রাণ ও ইন্দ্রিয়কে সহজে দমন করতে পারে।৩৩ যার রাজসিক ধৃতি তার বাসনা প্রবল হয়। সেই ব্যক্তি ধর্ম, অর্থ-কাম-মোক্ষ অপেক্ষাও বাসনাকে বড় মনে করে।৩৪ তামসিক ধৃতির বলে মানুষ নিদ্রা, ভয় ও শোক-দুঃখে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।৩৫ হে অর্জুন, সুখও ত্রিবিধ- সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক। সে সম্বন্ধে তোমাকে বলছি।৩৬ সাত্ত্বিক সুখে আনন্দ জাগে, সমস্ত দুঃখ দূরে যায় এবং পরিণাম সুখের হয়।৩৭ রাজসিক সুখ ইন্দ্রিয় হতে জন্মে। এটি প্রথমে খুবই আনন্দের, কিন্তু পরিণামে দুঃখময়।৩৮ নিদ্রা, আলস্য ও প্রমাদ হতে যে সুখ জন্মে তা তামসিক সুখ। এটি সর্বদাই মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে।৩৯ দেবতা, মানব বা অন্য কোনো প্রাণীই স্বভাব কাটিয়ে উঠতে পারে না।৪০ স্বভাবের গুণেই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র- এই চার জাতির বিভক্ত হয়েছে।৪১ শম, দম, ক্ষমা, তপস্যা, শৌচ, আস্তিকা, শুচিতা, জ্ঞান, সরলতা- এইসব ব্রাহ্মণের কর্ম।৪২ শৌর্য, বীর্য, পরাক্রম, যুদ্ধ, শাসন, প্রভুত্ব- এইসব ক্ষত্রিয়ের কর্ম।৪৩ কৃষি, গোপালন ও বাণিজ্য বৈশ্যের কর্ম। আর সেবা হচ্ছে শূদ্রের কর্ম।৪৪ মানুষ নিজ নিজ কর্মে রত থেকে সিদ্ধি লাভ করে। এ সম্বন্ধে তোমাকে বলছি।৪৫ হে অর্জুন, মানুষ স্বধর্ম পালন ক\'রে যিনি সর্বভূতে অধিষ্ঠিত সেই বিশ্বময়ের পূজা করে থাকেন।৪৬ স্বধর্ম দোষযুক্ত হলেও পরধর্ম হতে বড়। যে স্বধর্ম পালন করে তার কোনো পাপ হয় না।৪৭
স্বধর্ম দোষযুক্ত হলেও তা কখনও পরিত্যাগ করার নয়। অগ্নিতে যেমন ধুম থাকে স্বধর্মেও তেমন কিছুটা দোষ থাকবেই।৪৮ যে সংযত ব্যক্তি অনাসক্ত হয়ে কর্ম করে সে কর্মের বন্ধন হতে মুক্ত হয়।৪৯ হে অর্জুন, সিদ্ধিলাভ করলে কীভাবে ব্রহ্মভাব হয় তা তোমাকে বলব।৫০ বুদ্ধি দ্বারা মনকে নির্মল ও সংযত করবে। তবেই ভোগের বিষয়-সকল দূর হয়ে যাবে।৫১ নিরিবিলি থাকলে ও নিরামিষ খেলে মন সংযত হয়।৫২ অহংকার, বল, কাম, ক্রোধ, লোভ ত্যাগ করতে পারলে মন নির্মল হয়।৫৩ ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হলে মন সুপ্রসন্ন হয়। তখন সর্বভূতে সমদৃষ্টি হয় এবং আমার প্রতি ভক্তি লাভ করে।৫৪ আমি সর্বব্যাপী। ভক্তিভরে আমার স্বরূপ জেনে আমার ভক্ত আমাতেই প্রবেশ করে।৫৫ আমার ভক্ত সমস্ত কর্ম করেও আমার অনুগ্রহে অব্যয় পদ প্রাপ্ত হয়।৫৬ হে অর্জুন, তুমিও সমস্ত কর্মের ফল আমাতে সমর্পণ ক\'রে এবং আমাতে মনপ্রাণ রেখে স্বকর্ম করতে থাক।৫৭ মদগত চিত্ত হয়ে আমার উপদেশ অনুসারে চললেই তোমার মঙ্গল হবে।৫৮ অহংকারবশতঃ যদিও তুমি বল \"আমি যুদ্ধ করব না\" এটা ভুল। প্রকৃতিই তোমাকে কাজ করাবে।৫৯ যুদ্ধ তোমার স্বাভাবিক কর্তব্য। তুমি যদি স্বেচ্ছায় যুদ্ধ না কর তবে শেষ পর্যন্ত প্রকৃতির প্রভাবে তুমি যুদ্ধ করতে বাধ্য হবে।৬০ ঈশ্বর সকল প্রাণীর মধ্যে আছেন। তিনিই তাদেরকে যন্ত্রারূঢ় পুতুলের মত ঘোরাচ্ছেন।৬১ হে অর্জুন, তুমি সর্বভাবে তাঁরই শরণ লও। তাঁর অনুগ্রহেই তুমি শান্তি ও নিত্য স্থান লাভ করবে।৬২ অতিগুহ্য এই কথা তোমাকে বললাম। এটা শুনে যা সঙ্গত মনে কর তাই কর।৬৩ তোমার ভালোর জন্য সর্বাপেক্ষা গুহ্য কথাটি তোমাকে এখন বলব।৬৪ আমাতে মন নিবিষ্ট কর, আমার ভক্ত হও, আমাকে নমস্কার কর। তা হলে তুমি আমাকেই পাবে কেননা তুমিই আমার অতি প্রিয়।৬৫ সমস্ত ধর্ম-কর্ম বাদ দিয়ে তুমি আমারই শরণ লও। আমি তোমাকে সকল পাপ হতে মুক্ত করব।৬৬ যে ভক্তিহীন, স্বধর্মে যার নিষ্ঠা নেই এবং যে আমার নিন্দা করে, সেই সব ব্যক্তিকে গীতাশাস্ত্র বলবে না।৬৭ যে ব্যক্তি ভক্তির সাথে গীতাশাস্ত্র ভক্তজনদেরকে পাঠ করে শোনায় সে অন্তিমে আমাকেই পেয়ে থাকে।৬৮ মানুষের মধ্যে তার চেয়ে প্রিয় আমার আর কেউ নাই।৬৯ যিনি গীতা পাঠ করবেন তিনি জ্ঞানরূপ যজ্ঞদ্বারা আমারই পূজা করবেন- এটাই আমি মনে করি।৭০ যে ব্যক্তি ভক্তির সাথে গীতাশাস্ত্র শ্রবণ করেন তিনি পাপমুক্ত হয়ে পুণ্যলোক প্রাপ্ত হন।৭১ হে অর্জুন, তুমি মন দিয়ে আমার কথা শুনেছ তো? তোমার মোহ দূর হয়েছে তো?৭২ অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, তোমার অনুগ্রহে আমার মোহ দূর হয়েছে। আমার মন স্থির। আমার মনে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নাই।৭৩ হে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের এই কথোপকথন আমি শুনেছি।৭৪ মহর্ষি ব্যাসের অনুগ্রহে আমিই এই গীতা শ্রীকৃষ্ণকে বলতে ও অর্জুনকে শুনতে শুনেছি।৭৫ এই পুণ্যকথা আমি বার বার স্মরণ করছি আর বার বার আমার আনন্দ হচ্ছে।৭৬ বিশ্বরূপের দৃশ্যটি যতই আমার মনে পড়ছে ততই শরীর পুলকিত হচ্ছে।৭৭ যেখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ ও বীর অর্জুন বিরাজমান সেখেনেই জয় ও রাছলক্ষ্মী বিরাজ করবেন- এটিই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।৭৮
  Home
Log in



Ring ring